Thursday, November 19, 2009

অন্ধকারের পূনরাবৃত্তি

অন্ধকারের পূনরাবৃত্তি

১২ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১০:৪৫




সুনসান চারিদিক নিরব নিস্তব্ধ অন্ধকার গলিতে একলা হেটে চলেছে ছেলেটি রাতের বেলার অতি পরিচিত পথটিতে খুব প্রয়োজন না হলে দিনের বেলা তার চলাচল নেই বললেই চলে ... তাইতো রাতের অন্ধকার রাস্তাটি যেন অতি আপন জনের মতো আকড়ে ধরে রেখেছে হৃদয়ের কাছাকাছি .... সেদিন রাতে ঐ পরিচিত রাস্তায় চলতে গিয়ে হঠাৎ শুনতে পেল যেন করুন কোন আর্তনাদের সুর ... যেন চাপা স্বরে কেউ কেঁদে চলেছে এক টুকরো সাহায্যের প্রত্যাশায় ... বিভীষিকাময় অন্ধকারের পর্দা ভেদ করে করুন শব্দের উৎসে পৌছাতেই দেখতে পেল এক আহত চড়ুই পাখির বাচ্চা কাতর কন্ঠে আর্তনাদ করে চলেছে ... কোনো দুষ্টু ছেলের দল তার ডানা ভেঙ্গে দিয়েছে ... ডানা ভাঙ্গার অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করছে দেখে অন্ধকার মানুষটি তাকে আলতো করে পরম মমতায় কোলে তুলে নিলো ... একটু খানিক স্নেহের ছোঁয়া চড়ুই বাচ্চাটির হৃদয়ে যেন ভরিয়ে দিলো অনাবিল প্রশান্তির উষ্মতা ... চকিতে নজর পড়লো রাস্তার ওপারে দেয়াল ঘেষে কুকড়ে থাকা এক মানবীয় ছায়া মুর্তির উপর ... থরথর কাঁপতে থাকা ছায়ামুর্তির কাছে যেতেই শুনে গেল তার ফুঁপিয়ে কান্নার চাপা আর্তনাদ ... কাছে গিয়ে দাড়াতেই স্পষ্ট দেখা গেল তার ক্ষীন শরীরে আতংকে শিউরে ওঠা কাপুনি ... অস্ফুট গোঙ্গানীতে স্পষ্ট হলো তার নিরাপত্তাহীনতা ... হয়ত সে ভেবেছিলো এও ঐ সব শকুনের মতই আরেক নরখাদক ... শীতল কন্ঠের সাহায্য প্রদানে আগ্রহী কন্ঠস্বরটিকে যেন অথৈ সাগরে ডুবতে থাকা সাতার না জানা কারো কাছে পাশ দিয়ে ভেসে যাওয়া খড়কুটো মনে হতেই শত দ্বিধায় আন্দোলিত হৃদয়ে হাতটি ধরে দাড়িয়ে পড়লো এক টুকরো আলোর প্রত্যাশায় ....

ঘরটি বেশ অগোছালো, জানালা গুলো ভিতর থেকে শক্ত করে আটকানো আর তার উপরে ভারী পর্দা দিয়ে ঢাকা ... দেয়ালগুলো নোংরা না হলেও অযত্নের ছাপ বিদ্যমান , ঘরের প্রতিটি কোনা যেন মাকড়সাদের নিজস্ব সম্পত্তি ... ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘরের প্রতিটি জিনিস যেন চিৎকার করে এক এলোমেলো জীবনের বর্ননা দিয়ে চলেছে ... একটা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই এ বাড়ীতে বিদ্যমান তবে একটা বিষর স্পষ্ট যে এখানে মাত্র একজন ছাড়া আর কারো প্রবেশাধিকার নেই ... কিচেনে আসবাব পত্র সবই আছে শুধু একটি করে গ্লাস প্লেট আর চায়ের মগ ... বাথরুমটা বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে বানানো হয়েছিল কিন্তু চরম অবহেলার ছাপ পড়ে রয়েছে যত্রতত্র ... চারিদিকে এক নজর চোখ বুলালেই যে কারো মনে একটা কথাই উদিত হতে বাধ্য , আর তা হলো -- এই লোকটির জীবন যাত্রা একেবারে অন্যরকম .... বড়ই অদ্ভুত ....

কয়েক সপ্তাহ পরের ঘটনা,

চড়ুই পাখিটা এখন নিজে নিজে হেটে হেটে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়, যেন তার নিজের বাড়ির মতই ... ওর জন্য একটা জানালা সবসময় খুলে দিয়ে রাখা আছে যেখানে কয়েকদিন ধরে কিছু চড়ুই পাখির আসা যাওয়া লক্ষ্য করা যায় ... ওরা একসাথে সারাদিন খেলা করে ... আর সন্ধ্যা হলেই আহত চড়ুই এক বাচ্চাকে রেখে চলে যায় নিজেদের ঘরে ... অন্ধকার মানুষটি পরম মমতায় একদিন কাচা হাতে বেধে দেয়া ব্যান্ডেজ খুলে দেখে ভিতরের আহত অংশটা শুকিয়ে গিয়েছে ... এখন চড়ুই বাচ্চাটা একটু একটু করে উড়তেও পারে ... তবে কোন এক কারনে সে ঘরের বাইরে কখনো যায় না ... সবাই একসাথে খেতে বসলে অন্ধকার মানুষটির প্লেট থেকে টুক টুক করে খাওয়াটা যেন তার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে ... পাশে একটু খাবার ছিটিয়ে দিলেও সেখান থেকে সে খায় না ... ওদিকে ভয়ে কাতর মেয়েটিও বেশ গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে ... বাড়ীর প্রতিটি কোনে নিজের হাতে পরিষ্কার করেছে সে ... ঘরের প্রতিটি জিনিসকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে ঠিক ঠিক যায়গা মতো ... নিজের ঘরের মতই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে ঘরের অন্য দুটি প্রানীর সাথে ... প্রথমে প্রথমে একটু ভয় করলেও এখন সে অল্প বিস্তর বাইরের কাজও শুরু করে দিয়েছে ... টুকিটাকি জিনিস আর প্রতিদিনের বাজার করা সে নিজের কাজ মনে করেই করছে নিয়মিত .... আর অন্ধকার মানুষটি, অনেক বছর পর যেন সেই আগের রুপে দেখতে পাচ্ছে তার অতি পরিচিত এই বাসাটিকে ... অনেক বছর আগের মতই বাইরে একবেলাও না খেয়ে নিজের বাসাতেই আজকাল তারা তিনজনে একসাথে খাচ্ছে, দিনের বেলা সে বাইরে আগের মত কাজে যাচ্ছে ... রাতের জীবনকে ছুটি দিতেই আজ যেন খুজে পেয়েছে নিজের সেই হারিয়ে যাওয়া স্বকীয়তা .... এরপরে একদিন, অনেক চিন্তার পর অন্ধকার থেকে নিজেকে বের করে আনা মানুষটির আবার নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে হলো, আবার ইচ্ছে হলো নতুন করে জীবনটাকে সাজাতে ... ঠিক সেইভাবে শুরু করতে যেভাবে সে একসময় শুরু করেছিলো তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় ... সারাদিনের কর্মব্যাস্ততার পরে নিজের ভিতরটাকে ঠিকঠাক গুছিয়ে, এক হাতে একটি চড়ুই বাচ্চাটার জন্য নতুন একটা প্লেট আর মনের কোনে উকি দেয়া ফুটফুটে মেয়েটির জন্য একটি লাল টুকটুকি শাড়ী নিয়ে ঘরের দরজার দাড়াতেই আজ যেন সেই অনুভুতির ছওয়া পেল, যা আরো একদিন পেয়েছিল, অনেক বছর আগে .... এর পর দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই তার সাজানো গোছানো বিছানার উপর দেখতে পেল পাশাপাশি দুটি জিনিস ... চড়ুই পাখিটির খুলে ফেলা ব্যান্ডেজ আর একখানা কৃতজ্ঞতাপত্র ...



No comments: