Thursday, November 19, 2009

জীবন বদলে দেয়া চিরকুট

জীবন বদলে দেয়া চিরকুট

০৫ ই নভেম্বর, ২০০৯ দুপুর ২:০৪






উফফ !! অসহ্য এক বিশ্রী গন্ধে কেবিন টা ভরে রয়েছে, প্রথম দিন ডেটল দিয়ে মেঝে মুছে দেবার পরেই কেমন যেন গা গুলিয়ে আসছিল ওর তাই সাথে সাথে নার্সদেরকে ডেকে বলেছিল তার কেবিনে যেন এমন জীবানু নাশক ব্যাবহার করে যাতে এমন গন্ধ থাকবে না, এর পরে আজকে ওরা এমন কিছু লিকুইড মিশিয়ে ঘর পরিষ্কার করেছে যে তার গন্ধে এ কেবিনে টেকা দায় হয়ে পড়েছে .... এক কেবিনে ভারী পর্দা দিয়ে আলাদা করা দুজন রুগীর জন্য ... এমনিতেই অস্বস্হিকর পরিবেশ তার উপর বিশ্রী গন্ধ (এটাকে দুর্গন্ধ বলাই উত্তম) ... এ অবস্হার মধ্যে মরার উপরে খাড়ার ঘা হিসেবে হাসতে হাসতে সুমনার কেবিনে প্রবেশ করলো শুভ্র ... শুভ্র একই কেবিনের অন্য পাশের রোগী, খিটমিটে সুমনার রাগে গজ গজ করা শুনেই উৎসুক দর্শকের মত উকি দিয়েছে ওর এখানে ... আর ঢুকেই পাগলের মত খিটমিট করতে দেখে নিজর চুপ থাকা কে সামলাতে না পেরে ফিক করে হেসে দিয়েছে ... ব্যাস , শুরু হয়ে গেল সুমনার কেয়ামত ... চেনা নেই জানা নেই এভাবে এসে হাসবে কেন সে ? ... নক করে ঢুকে পড়েছে বলেই তাকে ভদ্র বলা যায়না তো ... কোথায় যে তাকে নিয়ে আসা হলো ... আব্বু আম্মুর উপর এখন তার আরো অনেক বেশী রাগ হতে লাগলো ....সব দোষ তাদের... ওদের জন্যই তো আজকের তার এইখানে আসতে হইসে ....

ঘটনার সূত্রপাত কয়েকদিন আগে ... সেমিষ্টার ফাইনালের চাপে অস্হির সুমনা ... বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান সেই সাথে ইনস্টিটিউটের অন্যতম মেধাবী শিক্ষার্থী , সুতরাং দুদিকের প্রত্যাশাকে পূরনের লক্ষ্যে রাত দিন এক করে পড়ছিল সে ... মাঝে মাঝে পড়ার চাপে চিড়েচ্যাপ্টা সুমনা কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে রেষ্ট নেয় অথবা পাপ্পুর সাথে গল্প করে মাথাটা ফ্রেশ করে নেয় ... পাপ্পু ওর খুব কাছের একজন বন্ধু, ওর কথা বলার ধরনটাই এমন যে শুনতে থাকলে শুধুই শুনতে ইচ্ছে করে ... সেও গল্প শুনিয়ে মজা পায়, তাই ওকে গল্প বলে যায় একের পর এক ... অনেক দিন ওর কাছে গল্প শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়েছে ... এভাবে চলতে চলতে এক রাতে ওর আব্বু এসে দেখে বিছানায় বই খুলে সুমনা কার সাথে যেন গল্পে মশগুল হয়ে আছে ... এই অবস্হা দেখে তিনি দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে বকে গেলেন কিছুক্ষন তারই আদরের মেয়েকে ... সবসময় তার সব কাজকে তিনি প্রশ্রয় দিলেও সেমিষ্টার ফাইনালের সময় তার এমন কাজকে তিনি কখনোই সমর্থন করেন না ... এদিকে পাপ্পু ফোনে থাকা অবস্হায় এমন বকা খাওয়ায় অপমানিত আর সেই সাথে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে শোনা কঠিন কথাগুলো সুমনার জন্য সহ্য করা সত্যি কষ্ট কর হয়ে পড়েছিল ... তাইতো সে রাগে, অপমানে, অভিমানে মায়ের ড্রয়ার থেকে চুরি করে আনা দু পাতা ঘুমের ঔষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছিল চির নিদ্রার অভিপ্রায়ে ... এর পরে কি হয়েছে সে নিজেও জানে না , গতকাল যখন চোখ খুলেছে তখন নিজেকে পেয়েছে এই কেবিনের ভিতরে ...

দরজায় ঠক ঠক নক ভিতরে আসতে পারি বলতে বলতেই পর্দা সরিয়ে কেবিনের ভিতর শুভ্র প্রবেশ করেই খিক খিক করে গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললো ... আমি শুভ্র (সুমনা মনে মনে বলে -- তোর নাম জানতে চেয়েছি নাকি ), এ কেবিনের ও পাশের বেডটাই আমার (সুমনা মনে মনে -- আমায় উদ্ধার করেছিস পাশে থেকে), এখানে কয়েকদিন থাকলেই এ গন্ধ আপনার সহ্য হয়ে যাবে (সুমনা মনে মনে -- তোকে এই দুর্গন্ধের উকালতি করতে বলেছে কে ?), আপনার কোন কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকতে পারেন (সুমনা মনে মনে -- গলায় দড়ি দিতে ডাকবো, চলবে ?)... এখন আসি , পরে কথা হবে (সুমনা মনে মনে -- দুর হ ! তোর মুখ আমি দেখতে চাইনা) ... কথাগুলো মনে মনে বললেও মুখে বলার মত অভদ্রতা করতে পারলোনা শুধু মাত্র দুটো মায়াভরা চোখের দিকে তাকিয়ে , তবে শুভ্র চলে যাওয়ার পরেই সে নার্সকে ডেকে বলে দিয়েছিল ওকে যেন মানা করে দেয়া হয় তার সাইডে আসতে .... কথাটি নার্স শুভ্রকে জানিয়ে দেয়ার পরে সেখান থেকেই চিৎকার বলে উঠেছিল .... জলদি সুস্হ হয়ে উঠুন তবেই আমার এ যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাবেন ....

এমনিতে সকাল থেকেই মেজাজ খারাপ তার উপরে শুভ্রর এই ফালতু আচরন মেজাজটা আরো বিগড়ে দিয়েছে ...ম্যুড ভয়ংকর খারাপ অথবা রাগ হলেই সুমনার না খাওয়ার একটা পুরোনো অভ্যাস আছে সেই সাথে এই মুহুর্তে ঔষধ না খাওয়ার এক রকম পণ করেছে সে, দরকার নেই তার ভাল হওয়ার; এমন অপমান আর বকা খাওয়ার পরে বেচে থাকারই ইচ্ছে নেই তার ... সে কারনেই সকালের নাশ্তা আর তার পর খেতে দেয়া ঔষধগুলো এখনো টেবিলের উপরেই পড়া আছে ... আগে আর কেউ না হোক আব্বুর মন খারাপ দেখে সে খেয়ে নিতো ... কিন্তু এবার সেই আব্বুই এমনভাবে তাকে বকা দিয়েছে, সুতরাং সে খাবেই না ... এবার সে দেখে নিতে চায় দুনিয়ায় কে আছে যে তাকে খাবার আর ঔষধ খাওয়াতে পারে ....

হাসপাতালের নার্সদের অনেক ধৈর্য্য, না হলে ওর মতো সব কিছুতে না বলা রুগীদের সাথে এমন করে সুন্দরভাবে কথা কেউ বলার কথা না ... ওর ঘুম ভাঙ্গার পর, সকাল থেকে দু জন ডাক্তার এসেছেন আর গোটা তিনেক নার্স ... সবার মুখেই হাসি... অমায়িক ব্যাবহার ... এদের মাঝে ডাক্তার দুজন আর দুজন নার্সকে ওর বেশ লেগেছে ... ঘর পরিষ্কার করতে আসা মহিলাটাও ওর বকা খেয়েও হাসি মুখে নিজের কাজ শেষ করে গিয়েছে, তার আচরনও ওর বেশ ভাল লেগেছে ... ডাক্তার দুজন সকাল থেকে কয়েকবার ওকে দেখে গিয়েছে ... দুজনেই বেশ সুদর্শন, মিষ্টিভাষী ... আর বেশ জলদি মিশতে পারেন ... অনেক ভাবে বুঝিয়েছেন উনারা, এই মুহুর্তে খাবার আর ঔষধ খাওয়াটা ওর জন্য খুবই জরুরী, কেবল মাত্র বেশ বড় একটা বিপদ কাটিয়ে উঠেছে সে, এখন যদি তার শরীরের ঠিকমত যত্ন না নেয়া হয় তবে আরো অসুস্হ হয়ে পড়বে ... উনাদের দুজনের কথা শুনতে তার বেশ ভাল লাগে, কিন্তু সে তো রাগ করে আছে না হলে কখন উনাদের কথা মত খাবার আর ঔষধ খেয়ে ফেলতো ... উনাদের দুজনেরই কয়েকটা কমন মুদ্রাদোষ আছে, যেমন " ঠিকাছে" " বুঝতে পারছেন" " তাইনা" "তাহলে" ... এগুলো যখনই ওরা বলে তার খুবই হাসি পায় কিন্তু অভিমানের সময় হাসতে নাই এ জন্য হাসি চাপতে সে ঐসময়গুলো উনাদের কথার উত্তর হ্যা, হু বলে দেয় ... যে দুজন নার্সকে ওর ভাল লেগেছে উনারা একেবারে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আম্মুর মতই আদর করে বুঝাতে চেয়েছেন , অন্য সময় হলে যে আদর উনারা করেছেন তার একশভাগের একভাগ করলেই সে যে কোন কাজ করতে রাজি হয়ে যেত ... আরেকজন খুবই সল্পভাষী, খেয়ে নিন না খেলে শরীর খারাপ করবে বলে চলে গিয়েছে ... তাকে তার সেইভাবে পছন্দ না হলেও অপছন্দ হয়নি ... তবে একটা ব্যাপার সবাই আলাদা আলাদাভাবে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে ... এবং শেষ পর্যন্ত বিফল মনোরথে ফেরত গিয়েছে ...

কিছুক্ষন থেকে তার মনের অবস্হা আরো খারাপ হয়ে আছে , তার প্রিয় মানুষ, তার আব্বু যিনি তার পাশে থাকার জন্য হাসপাতালে এসেছেন উনাকে শুভ্রর ডিস্টার্ব করার কথা বলাতে সেই যে ঐপাশে গিয়ে বসেছেন আর উঠে আসার নামই নাই ... একটু পর পর আবার ওরা দুজন কি নিয়ে যেন হো হো করে হেসে উঠছে, এমন অসভ্য একটা ছেলের পাশে বসে কি যে গল্প করে চলেছে আল্লাহ ই জানে ... এর মাঝে ৫ - ৭ মিনিটের জন্য তার পাশে এসে ওকে দেখে আব্বু বললেন -- মা, তুই কিছু খাবি ? ... ঝটকার সাথে "না" বলার পরে উনি দ্বিতীয়বার আর জিজ্ঞেস না করে ফলের ঝুড়ি থেকে ছুরি আর কয়েকটা আপেল, আঙ্গুর, বেদানা, কমলা নিয়ে আবার বেরুচ্ছেন দেখে সে জিজ্ঞেস করলো কৈ যাও ? তিনি একমুখ হাসি দিয়ে বললেন -- শুভ্রকে খাওয়ায়ে আসি ... চট করে যেন মাথায় রক্ত চড়ে গেল সুমনার ... ধীরে ধীরে সেটা ভয়ংকর রাগে পরিনত হতে থাকলো যখন ঐপাশ থেকে দুজন মিলে খাওয়ার কথা বলতে শুনলো ... উফফ ! এমন মিষ্টি কমলা খুব কমই খেয়েছি আংকেল ... আরে কালো আঙ্গুর, আমার খুব প্রিয় আপনিও নেন আঙ্কেল ... বেদানা এখন না পরে খাই, এমন খেলে তো আমার পেট ফেটেই যাবে, সুমনার বাবা বলেন -- আরে খাওতো, না হলে পিট্টি দিয়ে খাওয়াবো তোমাকে ... এ সবের মাঝেই দুপুরের খাবার নিয়ে স্বল্পভাষী নার্সটা হাজির হলো সুমনার কাছে, খাবারের ট্রে টা টেবিলের উপরে রেখে যাওয়ার সময় বলে গেল, একটু পরে আপনার ঔষধ দেয়া হবে ... বলেই সে চলে গেল

বেশ কিছুক্ষন থেকে সুমনার কাছে কেউ আসছে না, কোন ডাক্তার নার্স কেউ না, ওর বাবাও শুভ্রর কাছে বসে আছে ... জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে তাকাতে চোখ ব্যাথা হয়ে গিয়েছে মনে হয়, টিভি চালিয়ে ৩৭টার মধ্যে দেখার মত একটাও চ্যানেল খুজে পেল না বলে বিরক্তে চোখ কুঁচকে পাশে রাখা খাবারের ট্রের দিকে তাকাতেই এতক্ষনে খেয়াল করলো সেখানে খাবারের সাথে একভাজ করে রাখা একটা ছোট্ট চিরকুট পড়ে আছে ... কি মনে করে সেটা তুলে চোখ বুলাতেই দেখলো, তাতে লেখা --

" মেয়েটার নাম তনু, পড়তো শহরের নামী একটা স্কুলে ক্লাস টু তে, বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়াতে তারা কখনোই তার কোন কিছুর অভাব না রাখার চেষ্টা করেছেন, তবুও তার মনে সারাক্ষন এক বিষাদের ছায়া লেগেই থাকতো, স্কুল আর মায়ের সাথে শপিং ছাড়া তার বাকিটা সময় কেটে যেতে নিজেদের ফ্ল্যাটেই ... হয়ত কাছের কোন বন্ধু অথবা খেলার সাথী না থাকার কারনে অথবা ছোট্ট একটি গন্ডিতে আবদ্ধ হয়ে থাকার কারনেই সে আস্তে আস্তে বিষন্নতা নামক কঠিন অসুখে পতিত হচ্ছিল ....

পরবর্তি খাবারের ট্রেতে পাঠানো চিরকুটে জানতে পারবেন এরপর তনুর অবস্হাটা ঠিক কতটা খারাপ হয়েছিল, ঠিকাছে ?"


গল্পের বই এর পাগল সুমনার জন্য এটা কি পরিমান ভয়ংকর টর্চার তা সে ছাড়া আর কেউ জানে না, বুঝবেও না ... হঠাৎ করে দেখলো তার কুঁচকানো ভ্রু দুটো আরো বেকে রয়েছে, মাথাটা ভয়ংকর রকমভাবে ধরেছে , জানালা দিয়ে তাকাতেই যেন আকাশ পাতাল এক করে ঘুরে উঠলো সবকিছু .... কেন এমন হচ্ছে তার সাথে ... এ কি না খাওয়ার কারনে নাকি তনুর পরবর্তিতে কি হয়েছে তা জানার জন্য ? নাহ ! তার আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না ... বেল বাজিয়ে নার্সকে ডেকে বললো খাবার ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে আরেকবার দেয়া যাবে প্লিজ ? ... হাসিমুখে স্বল্পভাষী নার্স কয়েক মিনিটের মধ্যে তাকে গরম খাবারের ট্রে দিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে সেখান থেকে ছোঁ মেরে পরবর্তি চিরকুট টা তুলে নিয়ে খুলতেই সুমনার মেজাজটা চরমরকম খারাপ হয়ে গেল, সেখানে লেখা আছে

" একটুও খাবার না খেলে তো তনুর পরবর্তি ঘটনাগুলো বলা যাবেনা তাই কিছুটা হলেও আপনাকে খেতে হবে ... কিছু না হলেও অন্তঃত চিকেন স্যুপ এক গ্লাস পানি আর ঔষধগুলো যদি খান তো পরের অংশটা দেয়া যেতে পারে, ঠিক না ? "


এটা পড়তে পড়তে সুমনার যেন কান্না চলে এল, কি করবে সে ... একদিকে পাহাড়ের ন্যায় অটল অভিমান অন্যদিকে তনুর কি হয়েছিল জানতে অসম্ভব ইচ্ছে করছে ... অগত্যা হাফ বাটি স্যুপ, হাফ গ্লাস পানি আর ঔষধগুলো খেয়ে বাকি খাবার ফেরত দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো ... পরের খাবার কখন দেয়া হবে ? স্বল্পভাষী নার্সটা বললো -- বিকেলে নাশতা দেয়া হবে .... অতঃপর কি হলো তনুর সে চিন্তা করতে করতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানে না ... তার ঘুম যখন ভাঙলো তখন বিকেলের নাশতা দিয়ে একজন নার্স আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছিলেন ... ট্রের উপরে রাখা ছোট্ট চিরকুট টা দেখতে পেয়েই সে আবার এক নিঃশ্বাসে পড়া শুরু করে দিলো --

" তনুর বিষন্নতা আস্তে আস্তে বাড়তেই লাগলো, দিনের পর দিন এভাবে চলতে চলতে এক সময় দেখা গেল তার খাওয়া দাওয়া, ঘুম, পড়ালেখা সবকিছুর উপর অনিহা চলে এসেছে... দিনে দিনে তার ওজন কমতে লাগলো, নিজের ঘর থেকে বের হতো না, ঘরের লাইট ও জ্বালাতে দিতো না, সেই সাথে সবার সাথে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিল ... কত ডাক্তার, প্রফেসর দেখানো হলো কেউ বুঝেই উঠতে পারছিলো না ওর কি হয়েছে, কেন হয়েছে... এমনকি একদিন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেই বসলেন এমনটা চলতে থাকলে হয়ত তাকে আর বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখাই সম্ভব হবে না ... তনুর জন্য দুঃশ্চিন্তায় অস্হির বাড়ির প্রতিটি লোক ... ওর বাবা মা থেকে শুরু করে কাজের লোক, বাবুর্চি, ড্রাইভার এমনকি দারোয়ানও ... এমন একদিন, উদ্ভ্রান্তের মত ছুটতে ছুটতে মায়ের কাছে এসে সে বললো -- মা আমদের অনেক খাবার তো ফেলে দেয়া হয় সেখান থেকে কিছুটা আমাকে দিবা ? .....

এর পরে কি হয়েছিল জানতে পারবেন পরের চিরকুটে, তবে এর জন্য আপনাকে অবশ্যই বিকেলের নাশতার পুরোটুকু খেতে হবে, ঠিক আছে?"

মায়ের কাছে এভাবে ফেলে দেয়া খাবার চাওয়ার কথাটা পড়তে পড়তে সুমনার চোখ দিয়ে কখন যে টপ টপ করে পানি পড়তে শুরু করেছে সে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি ... এমন সুন্দর টুকটুকে আদুরে মেয়েটা কি শেষ পর্যন্ত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো যে ভালো খাবারের পরিবর্তে ফেলে দেয়া খাবারের সন্ধান করছে ? ... এমন একটা ফুটফুটে বাবুকে সুস্হ করতে জান দিয়ে হলেও চেষ্টা করতো , তাইতো এরপর তনুর কি হয়েছে জানার জন্য সে এখনি আহত পাখির মত ছটফট শুরু করে দিয়েছে ... গোগ্রাসে বিকেলের খাবার সব শেষ করে বেল বাজিয়ে নার্সকে ডেকে জিজ্ঞেস করবো রাতের খাবার কখন দিবে ... রাত ৮ টার সময় রাতের খাবার সার্ভ হয় শুনে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আৎকে উঠলো সুমনা ... এখনো ৩ ঘন্টা পরে ? .... সে জিজ্ঞেস করলো -- তার যদি জলদি ক্ষিধে পায় তবে কি কিছু পাওয়া সম্ভব ? ... মায়ের মত আদর করা ওর অন্যতম প্রিয় নার্সটি ওর কপালে একটা ছোট্ট চুমু দিয়ে বলে, তোমার যখনই খেতে মন চাইবে খালি বেল বাজিয়ে বললেই তোমাকে সার্ভ করা হবে ... ঠিকাছে ? ... সে চলে যেতেই এতক্ষনে সুমনা চোখ পড়লো ওর বাবার উপরে, কখন যে উনি মা কে নিয়ে তার বিছানায় পাশে দাড়িয়েছেন বুঝতেই পারেনি... জ্বরে অসুস্হ মা মেয়েকে দেখতে ছুটে চলে এসেছেন হাসপাতালে, ওদিকে কিছুক্ষন সুমনার খোজ খবর নিয়ে ওর বাবা চলে গেলেন শুভ্রর কাছে, এই না দেখে সুমনা এক গাদা অভিযোগ করে বসলো মায়ের কাছে, মেয়েকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে দিতে তিনিও বাবাকে অনেক বকা দিলেন ... ঘন্টা খানিক পরে ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে তিনি চলে গেলেন বাসায় ... আম্মু চলে যাওয়ার পরে পরেই তনুর কথা মনে পড়তেই রাজ্যের ক্ষিদে যেন সুমনার পেটে এসে বাসা বাধলো ... সাথে সাথে ডিং ডং করে ঘন্টা বাজিয়ে কিছু একটা খাবে জানাতেই হাসিমুখে স্বল্পভাষী নার্সটা চলে গেল খাবার আনতে ... যাওয়ার সময় বলে গেল - রাতের খাবারের সময়ের অনেক আগেই চাওয়া হয়েছে বলে আসতে একটু দেরী হতে পারে...

আধ ঘন্টার মাথায় খাবারের ট্রে হাতে প্রিয় এক নার্সকে আসতে দেখে সুমনা খাবারের চেয়ে ট্রে তে কোন চিরটুক আছে কি না দেখার জন্য রীতিমত দাড়িয়ে পড়লো ... ছোট্ট একটা আদর দিয়ে নার্স ওর হাতে চিরকুট টা দিয়ে বললো এটার জন্যই দুষ্টুটার ক্ষিদে পেয়েছিল তাই না ? ... চিরকুট টা পেয়ে আর এমন আদুরে কথা শুনে সুমনা যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল ... আর কাল ক্ষেপন না করেই ও পড়তে শুরু করলো এবারের বেশ বড় চিরকুট টা ...

" অবাক চোখে মেয়ের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মা বললেন কেন মামনি, ও খাবার কেন , তোমাকে টাটকা কিছু বানিয়ে দিতে বলি ? ... কিন্তু তনুর না সূচক ঘাড় নাড়িয়ে বললো - ওগুলো তো ফেলেই দিবে, এর চেয়ে আমাকে দাও না প্লিজ ... মেয়ের কথা ফেলতে না পেরে কাজের বুয়াকে দিয়ে তিনি বাসি ভাত পাঠিয়ে দিয়ে দরজার আড়াল থেকে শোনার চেষ্টা করতে লাগলেন তার মেয়ে কি করে ... ততক্ষনে খবর পেয়ে তনুর বাবাও অফিস থেকে ছুটে এসেছেন দেখতে তার মেয়ে কি করে , কিছুক্ষন পরে ঘরের বাইরে থেকে তনুকে একমনে নিজে নিজে কথা বলতে শুনে একসাথে দুজনেই ভিতরে গিয়ে দেখে তনু খাবারগুলো একটু একটু করে বাইরে ফেলছে আর বলছে -- আসো আসো খাও, আরেকটু খাও ... বাবা মা কে ঘরে ঢুকতে দেখেই ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ থাকতে বলে হাতের বাটির সবটুকু ভাত বাইরে ফেলে একটু পরে ইশারায় বললো -- এদিকে আসো। আস্তে আস্তে উনাদের হাত ধরে জানালার কাছে আনতেই অবাক নয়নে তারা দেখলেন কার্নিসের কোনায় একটা ছোট্ট চড়ুই পাখির বাসা... সেখানে এক মা চড়ুই পাখি তনুর দেয়া খাবার গুলো খুটে খুটে তুলে নিয়ে বাচ্চাদেরকে খাওয়াচ্ছে ... তাই দেখে আনন্দে ও মুখ টিপে হেসে চলেছে, শব্দ করছে না, পাছে যদি ওদের ডিস্টার্ব হয় .... এর পর থেকে প্রতিদিন সময় মত তনু ঐ পাখির বাচ্চাদের সাথে গল্প করা আর খাবার খাওয়াতে শুরু করলো, এভাবে চলতে চলতে কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল সবগুলো চড়ুই আর কার্নিস থেকে না, বরং তনুর জানালায় বসে খাবার খাচ্ছে ... সেই সাথে তনুও কিছু দিনের মধ্যেই একেবারে ঝরঝরে সুস্হ হয়ে উঠলো ... আগের যে কোন সময়ের চেয়ে উচ্ছল আনন্দে নিজের সব কাজ উৎসাহের সাথে শেষ করার পাশাপাশি সময়মত চড়ুইদের খাবার খাইয়ে, ওদের সাথে নিজের সারাদিনের গল্প করে বেশ কাটছিল দিন গুলো .... হঠাৎ একরাতে অন্ধকার মেঘে ভর করে দুরন্ত গতিতে ছুটে এলো কালবৈশাখী ঝড়, উড়িয়ে তাড়িয়ে ধ্বংস করে দিলো অনেকের সাজানো সংসার ... সেই সাথে কার্নিসে বানানো চড়ুই পাখির সাজানো ছোট্ট ঘর আর তনুর মুখে এতদিন লেগে থাকা আনন্দের হাসিটি ...

এবার সত্যি সুমনার কান্না পেতে লাগলো ... সামনে রাখা ডিনার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তনুর কি হলো না জানলে যে খেতেও পারছে না, অন্যরকম এক মায়ার বাধনে জড়িয়ে পড়েছে সে তনুর সাথে ... যেভাবেই হোক ওকে জানতে হবে এর পরে তনুর সাথে কি হয়েছিল ... মনে মনে নতুন এক বুদ্ধি এঁটে সে গপাগপ খেয়ে নিলো ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ডিনার ... ডিং ডং ঘন্টা বাজিয়ে খাবারের ট্রে ফেরত পাঠানোর সময় নার্সকে জিজ্ঞেস করলো রাতে ক্ষিদে পেলে কি সে কিছু চাইতে পারে ? ... হাসিমুখে হ্যা বলেই স্বল্পভাষী নার্সটা চলে গেল ... সে যেতে না যেতেই ওর কেবিনে বাবা ঢুকে ওর শরীরের অবস্হার কথা যেনে বসেই রইলেন ওর পাশে ... তনুর জন্য অস্হিরতা অথবা অন্য কোন কারনে এখন কেন যেন বাবার সাথে অভিমান করতে মন চাইছে না সুমনার ... শুধু একবার জিজ্ঞেস করলো -- তুমি এখানে ? ওপাশের মানুষটা কি ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি ? ... ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আদরের মেয়েটিকে বুকে টেনে নিয়ে কিছুক্ষন বসে থাকার পরে বললেন -- শুভ্রর অবস্হা বেশী ভাল না, এজন্য ওকে ইন্টেনসিভ কেয়ারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ... সুমনা এই প্রথম শুভ্রর জন্য হঠাৎ করেই বেশ কষ্ট অনুভব করতে লাগলো ...

কিছুক্ষন পর রাউন্ডে আসা ডাক্তার ওকে পরীক্ষা করে বেশ খুশী মনে বললেন, আপনার শরীরের যথেষ্ট উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করার কারনেই আপনি অনেক সুস্হ হয়ে উঠেছেন, আশা করি কাল সকালেই আপনি বাড়ী যেতে পারবেন ... কথাটা শুনে যে কারো মনে আনন্দের সূচনা হওয়াটা স্বাভবিক হলেও সুমনার ঘরে ফেরার এক বিন্দু ইচ্ছে নেই ... বরং মনে মনে সে ঠিক করে ফেলেছে, এর পর তনুর কি হয়েছিল না জেনে সে এখান থেকে বেরুবে না ... আদরের মেয়েটাকে এভাবে চুপ করে মন খারাপ করতে দেখে ওর বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে মা এমন করে আছিস কেন ? ... কষ্টগুলোকে আর ধরে রাখতে না পেরে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হু হু করে কেঁদে উঠে সুমনা তাকে সব ঘটনা খুলে জানালো ... সেই সাথে এটাও বললো - তনুর কি হয়েছে আর কে এই গল্প লিখে লিখে তাকে খাইয়েছে না জানা পর্যন্ত সে হাসপাতাল ছেড়ে যাবে না ... মেয়ের এই ইচ্ছেটাকে পূরনের লক্ষ্যে সুমনার বাবা চললেন এ দুটি প্রশ্নের খোজে ... কিছুক্ষন পর ফিরে এসে বললেন , তোমার দুটি উত্তর পেয়েই তুমি কাল সকালে বাড়ী ফিরতে পারবে ...

তখন মধ্যরাত পাশের চেয়ারে বসে ওর বাবা ঘুমুচ্ছেন ... কিন্তু সুমনার চোখে ঘুম নেই, তনুর কি হয়েছিল এর পরে ? ... না জানলে যে ওর ঘুমই আসবে না আজ রাতে ... ডিং ডং ঘন্টা বাজিয়ে কিছু হালকা খাবারের কথা জানানোর কিছুক্ষন পরেই এক মমতাময়ী নার্স এসে ট্রেতে কিছু কুকিজ আর এক গ্লাস গরম দুধ দিয়ে গেল, যাওয়ার সময় ওর কপালে চুমু দিয়ে যেতে যেতে বললো -- শুনলাম কাল সকালে চলে যাবে তুমি ... আর কখনো যেন এমন কোরোনা , আচ্ছা ? ... কথা শেষ হওয়ার আগেই ডিউটিতে থাকা ডাক্তার এসে বললেন -- আপনি রাতে ঘুমানোর চেষ্টা করেন, তা না হলে আপনার শরীরের যতটুকু উন্নতি হয়েছে তার চেয়ে বেশী খারাপ হয়ে যেতে পারে ... ট্রের দিকে তাকিয়ে এরপর তিনি বললেন -- ওগুলো খেয়ে শুয়ে পড়ুন, ঠিকাছে ? শুভরাত্রী .... ওরা দুজনেই চলে যাওয়ার সাথে সাথে ট্রে তে রাখা চিরকুট টা তুলে নিয়ে ও পড়তে লাগলো ...

"ঝড়ের পর থেমে তনুর মনে এক ফোটা আনন্দ নেই, নেই সেই আনন্দের উচ্ছলতা ... ভেজা চোখে চুপচাপ বসে থাকা জানালায় ... কারো সাথে কথা বলে না ... পাখিদের ঠিক যে সময় খাবার দিতো , অভ্যাস বশত রান্নাঘর থেকে কিছু খাবার এনে জানালায় ছড়িয়ে দিয়ে চুপ চাপ অপেক্ষা করতে লাগলো কখন আসবে ওরা, কখন খাবে ওর দেয়া খাবারগুলো ... মেয়ের এই কান্ড দেখে আর বাবা মা কারো সহ্য হয় না ... ফুপিয়ে কেদে উঠে দুজনেই অন্য রুমে চলে যায় ...যেখানে নিরবে ফেলতে পারবে ওদের দু ফোটা চোখের জল ... হঠাৎ ছোট্ট দুটি হাতের ছোয়ায় দুজনেই চমকে উঠলো তাকিয়ে দেখলো হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে তনু ... ওরা তার দিকে তাকাতেই ফিসফিসিয়ে বললো -- এদিকে এসো, দেখে যাও ... গুটি গুটি পায়ে ওরা তিনজনে তনুর ঘরের দরজার দাড়িয়ে দেখতে লাগলো এক অপূর্ব দৃশ্য ... জানালার উপরে বসে একমনে টুক টুক করে খেয়ে চলেছে কয়েকটি ছোট্ট চড়ুই পাখি ।।"

আপনি জানতে চেয়েছেন -- গল্পটা আপনাকে কে শুনালো, এর উত্তর পাবেন কাল সকালে... ডিসচার্জ হওয়ার সময় আমার শেষ চিরকুটে... শুভ রাত্রী ।"


চিরকুট টা পড়ে সুমনার মনে যেন আর আনন্দ ধরে না ... তনুর গল্পটা শেষ হয়েছে, সকালে যে জানতেও পারবে কে তাকে গল্পটা শুনিয়েছে ... এই খুশীতে কখন যে তার চোখ লেগে এসেছিল সে নিজেই জানেনা , সকালে তার আব্বুর ডাকাডাকিতে চোখ খুলতেই তিনি বললেন ,সকাল হয়ে গিয়েছে নাও চলো বাসায় যাই ... সে উঠে ফ্রেস হয়ে আসতে না আসতেই ওর বাব বললেন , তোমার ডিসচার্জের সব পেপার রেডি করে এনেছি ... এবার চলো যাই ... বাবার পাশে দাড়িয়ে সুমনা বললো, এর মাঝে কোন চিরকুট নেই বাবা ? শেষ একটা আসার কথা ছিল ... খুশীর ঝিলিক তোলা চোখে ফাইলের ভিতর থেকে সুমনার জন্য আসা শেষ চিরকুট টা সুমনার হাতে দিয়ে তিনি দাড়ালেন তার অতি আদরের মেয়ের পাশেই ... আর সুমনা পড়তে থাকলো --

" ছোটবেলায় তোকে যে প্রতিদিন গল্প শুনাতাম আর তুই মায়ের হাতে ভাত খেতি মনে আছে ? না হয় অনেক দিন তোকে গল্প শুনাইনি, তাই বলে কি ভেবেছিস বাবা টা অনেক বোকা হয়ে গিয়েছে ? সে কি পারবে না তার মেয়ের অভিমান ভাঙ্গিয়ে গল্প শুনাতে শুনাতে খাবার খাইয়ে দিতে ? এবার বল, এমন একটা গল্প লেখার জন্য আমাকে কত নম্বর দিবি ? "


চিরকুট টা পড়া শেষ করতেই বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে তার সেই ছোট্ট আদরের মেয়েটা ফিক করে হেসে বলে উঠলো -- তোমাকে একশ তে একশ দশ দিলাম বাবা....




No comments: