ইচ্ছে পূরনের স্বপ্ন যাত্রা
০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৫:৫৫

সবাই বলে জন্মের সময় তার মা মারা গিয়েছিল, আর তার আগেই নাকি কোন এক এ্যাক্সিডেন্টে তার বাবা ... এর পর রিক্সাওয়ালা চাচাই তাকে কুড়িয়ে এনেছিল তার ছোট্ট কুড়ে ঘরে... নিজের ঘর সংসার না থাকায় এ ছেলেটিই হয়ে ওঠে তার সব কিছু ... নিজের ছেলের মতো আদরে তাকে বড় করে তুলতে দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতে গিয়ে নিজেই অসুস্হ হয়ে পড়ে ছিলেন কয়েক দিন ... এর পরে হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেলেন অন্য পারে .... তখন তার বয়স আর কত হবে, চার কি পাঁচ ... তখন থেকেই পাশের ছোট্ট হোটেলের মালিক তাকে ছোট খাট কাজের জন্য নিজের কাছে রেখে দেয় ... সারাদিন তার সব কথা কাটায় কাটায় ঠিক রেখে করলেও যেন কোনভাবেই যেন তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে না অথচ সে সারাদিনের কাজের বিনিময়ে শুধু তিন বেলা খাওয়া ছাড়া একটা পয়সাও পায় না ... এ নিয়ে তার মাঝে মাঝে দুঃখ হলেও মুখ ফুটে কখনো কিছু বলতে পারে না ...
হোটেলে প্রতিদিন কত মানুষ আসে, কত রকম খাবারের অর্ডার দেয় তারা, তাদের ছোট ছোট জিনিস এগিয়ে দিতে দিতে কোন সময় যে সবার কাছে তার আসল নামের পরিবর্তে পিচ্চি নামে পরচিত হয়ে গিয়েছিল, সে নিজেও জানে না ... আজকাল নিজের নাম কারো মুখে না শুনতে শুনতে পিচ্চি ছাড়া নিজের আর যে কোন নাম কখনো ছিল তাই সে ভুলে গিয়েছে ....
হোটেলে টাইম অনুযায়ী কিছু বাধা কাস্টমার আছে ... যেমন বেশী সকালে যারা আসে তারা নাস্তা করেই হুড়মুড় করে চলে যায় বেশিক্ষন থাকে না ... মাঝের সময়ে যারা আসে তারা একটু আরাম আয়েশ করেই নাস্তা খায় ... দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত একই ভাবে কিছু মানুষ আসে ... ঠিক একটা থেকে দুইটার মধ্যে যারা আসে তারা জলদি খেয়ে দৌড় দেয় আর অন্যরা খেতে বসলে এমনভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে আয়েশ করে খায় যেন শুধু খাওয়া না হজম পর্যন্ত করে তার পরে এখান থেকে বেরুবে ... বিকালের মামু রা পিচ্চির সবচেয়ে ফেভারেট কাস্টমার ... ওরা কি সব পলিটিস পলিটিস কথা বলে ... পলিটিস কি জিনিস পিচ্চি এখনো সেটা না বুঝলেও এতটুকু বোঝে যে ঐটা একটা বড় - সড় কোন কাজ ... যেখানে অনেক টাকা পাওয়া যায়, যারা ঐ কাজ করে অনেক মানুষ তাদের কে ভয় পায় কারন তারা অনেক শক্তিশালী হয় ... এই যে মামু গুলো এখানে আসে এদেরকে তো পিচ্চির বস পর্যন্ত সমীহ করে চলে ... একসাথে অনেক মামু আসলে অনেকে তাদের জন্য জায়গা ছেড়ে দেয় ... মাঝে মাঝে কিছু দুষ্টু মামু খাওয়ার দাওয়া করে এমনি এমনি চলে গেলেও হোটেলের কেউ কিছু বলে না ... অথচ অন্য কোন কাস্টমার এমন করলে কয়েকবার তাদেরকে তো পিটুনি পর্যন্ত খেতে দেখেছে .... আজকাল পিচ্চির মনে একটা স্বপ্ন মাঝে মাঝে উকি দেয় ... সে ঐ মামুদের মতো পলিটিস করবে ... অনেক টাকা বানাবে, এর পরে এই রকম একটা হোটেলের মালিক হবে ....
কথায় কথায় একদিন এক মামু কে সে বলে ফেলেছিল কথাটা ... মামুটা অন্য সব মামু থেকে বেশি ভাল ... কখনো কাউকে বকা দেয়নি ... রাগ করে কখনো চোখ রাঙ্গায়নি ... প্রতিবার বিল দেয়ার সময় বেশী টাকা দেয় আর যে জিনিসটা পিচ্চির সবচেয়ে বেশী ভাল লাগে তা হলো প্রতিবার উনি আসলেই তাকে দুই - পাচ টাকা টিপস দিয়ে যায় ... এছাড়া উনাকে ভাল লাগার অন্য একটা কারন ও আছে ... একদিন এই মামু বিরানী খাচ্ছিলো আর পিচ্চি সেটা দুর থেকে দেখছিল ... মনে মনে তারও খুব বিরানী খেতে ইচ্ছা হয়েছিল ... মামুটা কিভাবে যেন যেনে গিয়েছিল তার মনের কথা ... যাওয়ার সময় কিছু টাকা বেশী দিয়ে ওর বসকে বলেছিল পিচ্চিকে এখনই যেন পেট ভর্তি করে বিরানী খাওয়ানো হয় ... এর পরে ওর বস কেমন ভালো-মানুষের মতো ওকে পেট ভর্তি করে টাটকা বিরানী খাইয়েছিল ... মনে পড়তেই একটা অন্যরকম আনন্দের অনুভুতি মনের ভিতর দোলা দিয়ে যায় ... সেই মামু কে একদিন সাহস করে বলে ফেলেছিল তার স্বপ্নের কথা , তখন মামু মুচকি হেসে বলেছিল -- ঠিকাছে ... তোকে একদিন আমাদের সাথে নিয়ে যাব পলিটিক্স করতে ... আনন্দে তার চোখে সেদিন পানি এসে গিয়েছিল ... তাই দেখে মামু তাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে নতুন একটা বিশ টাকার নোট দিয়ে বলেছিল ... নে, এইটা তোর পলিটিক্সে প্রথম ইনকাম ! ... সেই দিন থেকে পিচ্চি অপেক্ষা করে চলছে, কবে মামু তাকে নিয়ে যাবে তাদের সাথে পলিটিস করতে ....
অপেক্ষার পালা শেষ করে একদিন সত্যই এলো সেই ক্ষন ... রান্না ঘরে সেদিন অনেক প্লেট জমে ছিল, তাই বুয়ার সাথে মিলে সে ওগুলো পরিষ্কার করছিল ... সেটা শেষ করে বাইরে আসতেই ওর বস বললো - এক মামু এসে নাকি বলে গেছে ঐ ভালো মামু টা পিচ্চিকে জলদি রাস্তার মোড়ে উনার অফিসের সামনে যেতে বলেছে ... শুনতে দেরী কিন্তু দৌড়াতে দেরি নাই ... এমন ভাবেই এক দৌড়ে সে মামুর অফিসের সামনে গিয়ে দেখে সেখানে অনেক মানুষ জমা হয়েছে ... আরো মানুষ দলে দলে আসছে ... ভিতরে দরজা বন্ধ করে মামু রা কি জানি কথা বলছে ... আর বাইরের সবাই এক অন্যরকম উত্তেজনায় ছটফট করছে ... এদের মাঝে থাকতে থাকতে পিচ্চির এক অন্যরকম উত্তেজনায় রক্ত টগবগ করা শুরু করলো ...
একটু পরে কয়েকজন মামু ভিতরের দরজা খুলে বের হয়ে আসলেন, এসে বললেন আজকে মিছিল হবে ... কোন কোন দিক দিয়ে ঘুরবে, তাতে কি কি শ্লোগান দেয়া হবে ... অল্প কিছু মামু কে বলা হলো কে কে কোন দিকে থাকবে ... এক সময় সেই ভালো মামু পিচ্চিকে ডাকলেন ... বললেন ... আজকে তুই সবার সামনে থাকবি ... পারবি না ? ... এক লাফে রাজি হয়ে উঠে পিচ্চি বললো -- আপনি বললে জান দিতেও রাজি মামু

একটু পরেই মিছইল শুরু হলো ... উফ ! সেকি শ্লোগানের গর্জন ... এ গর্জন শুনে পিচ্চির পায়ের রক্ত যেন মাথায় উঠে যাচ্ছিলো ... হাত পা ছুড়ে শ্লোগান দিতে দিতে মিছিলকে সে যেন একলাই টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো ... আর যাবেই না কেন ... এ যে তার ইচ্ছে পূরনের স্বপ্ন যাত্রার শুরু .....
হঠাৎ সামনের এক চিপা গলি থেকে কয়েকজনকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল ....
এর পর পরই শোনা গেল একসাথে কয়েকটি অদ্ভুত শব্দের ঝনঝনানি ..... ঠাস, ঠাস, ট্যাররর.... ঠাস ......
No comments:
Post a Comment