Tuesday, September 1, 2009

একমূখী রাস্তার শেষপ্রান্তে দাড়িয়ে !!

একমূখী রাস্তার

শেষপ্রান্তে দাড়িয়ে !!


৩১ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ১০:১২





মহল্লাটা পুরোনো বাড়ীতে ভর্তি ... নতুন বাড়ি হিসেবে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা বিল্ডিং মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে ... গলির মুখের টং এর দোকানটিতে চানমিয়া সারাদিন পুরোনো দিনের গান বাজাতে থাকে ... তার পাশেই রয়েছে কয়েকটি মুদি দোকান, একটা বেকারী ... এই এলাকা নিয়ে কিছু বিশেষ কিছু কল্প-গল্প প্রচলিত থাকায় স্হানীয় বাসিন্দা ছাড়া নিতান্ত অপারগ না হলে ভাড়াটিয়া হয়ে আসতে চায় না কেউ ... ঠিক তেমনি অন্য এলাকায় নিজের সামর্থ্যের মধ্যে বাসা না পেয়ে অপারগ সুজন এই এলাকায় পা রাখতে বাধ্য হয় ... এখানে বাসা খুজতে এসে নতুন বিল্ডিং এ দুই বেড রুমের বাসা এত অল্প ভাড়ায় পেয়ে যাবে কল্পনাও করেনি ... এখানে একলা থাকলেও সে বেশ সাচ্ছন্দ্যের সাথে চলতে পারবে, আর যদি কেউ সাবলেট হিসেবে তার সাথে থাকে তবে তো সোনায় সোহাগা ... বাড়ীওয়ালাও বেশ হাসিখুশী, ব্যাচেলর ভাড়া দিয়েছেন কোন রকম শর্ত ছাড়াই ... এমন অমায়িক মানুষ আজকের দিনে পাওয়া মুষ্কিল ...

নিজের সম্বল দুটো ব্যাগ নিয়ে সেদিন বিকেলেই হাজির হয়ে গেল নিজের নতুন বাসায়... এ শহরে মাঝারী মানের চাকুরী করতে আসা সুজনের এখনো কোন বন্ধু তৈরী হয়নি... তাই নিজে নিজে অফিস থেকে ফিরে বাকি সময়টাতে সব কটা রুম পরিষ্কার করে ঘর গুছিয়ে ফেলতে কয়েকটা দিন চলে গেল। যাওয়া আসার পথে মুদি দোকান গুলো থেকে প্রয়োজনীয় ছোটখাট জিনিস কিনলেও চানমিয়ার দোকানে কখনো যায়নি। সেদিন সন্ধ্যায় প্রতিদিনের মত ঘন্টা দুয়েকের জন্য কারেন্ট চলে যাওয়ার পরে সুজন ঘর থেকে বেরিয়ে চান মিয়ার দোকানে এক কাপ চা খাচ্ছিলো আর হালকা গল্প করছিল ... হঠাৎ কোন কারন ছাড়াই চান মিয়া বলে উঠলো -- ভাইজান, আপনি তো মনে হয় ১৫ নং বাড়িতে নতুন এসেছেন তাই না ? একটু সাবধানে থাইকেন ... হঠাৎ চানমিয়া তাকে কেন এ কথা বললো তা জিজ্ঞেস করতে যাবে, অমনি গলির অপর প্রান্তে কয়েকটি মটর সাইকেলের আলো দেখতে পেয়ে সে বলে উঠলো -- ভাইজান আপনি যান গা এক্ষুনি , তারিক ভাই আইতাছে , উনি আর উনার দোস্তরা আইলে এইখানে আর কাউরে বসার অনুমতি নাই ...সুজনের চায়ের দামটা পর্যন্ত না নিয়ে ঐ মুহুর্তে তাকে একরকম তাড়িয়ে দিতেই মনের মাঝে একটু খচখচ করতে থাকলো ... তারেক আর তার সঙ্গীরা চানমিয়ার দোকানের সামনে এসে মটরসাইকেলের উপরে বসেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো সুজনের ১৫ নং বাসার দিকে হেটে যাওয়া ... একসময় সে মেইন গেট পার হলে পরে ওরাও বসে পড়লো নিজেদের প্রাত্যহিক আড্ডায় ...

এর পরদিন সন্ধ্যায় আবার কারেন্ট চলে গেলে একলা ঘরে ভাল লাগছেনা দেখে ভাবলো চানমিয়ার দোকানে গিয়ে এক কাপ চা খেলে মন্দ হয় না, তবে তারেকদের কথা চিন্তা করে সে চিন্তা নিজের মাথা থেকে বাদ দিয়ে দিলো ... তারেক কে শুধু এই মহল্লায় না বরং এই শহরের বেশীর ভাগ মানুষ চিনে ... তার নামে সব রকমের ভয়ংকর কাহিনী বাতাসে ভেসে বেড়ালেও কোন চাক্ষুস প্রমান না থাকায় পুলিশ পর্যন্ত তাকে কখনো ছুতে পারেনি ... সাত পাচ ভেবে ঘরে তালা লাগিয়ে সুজন পা এগিয়ে দেয় বাড়ীর ছাদের দিকে ... অন্ধকার ছাদে প্রথম উঠতেই কেমন জানি একটা গা শিরশির করতে থাকে তার ... মোবাইলের আলোয় আধো আলো - আধো অন্ধকারে ছাদের এক কোনায় গিয়ে মুক্ত হাওয়ায় বসে আকাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ যেন শুনতে পেল কারা যেন হেটে আসছে ছাদের দিকে ... একজন, দু জন ... নাহ, পায়ের শব্দে মনে হয় ওরা কয়েকজন ...

কিছুক্ষন পরে কয়েকটি অস্পষ্ট ছায়াকে দেখতে পায় যারা ছাদের এক কোনায় গিয়ে দাড়ালো, ফিসফিস শব্দে নিজেদের মাঝে কথা বলতে থাকায় সে বুঝতেও পারছিলো না ওরা কারা ... কিছুক্ষন পরে সেল ফোনে ছোটভাই কল দিলে সেটা রিসিভ করতেই ছায়াগুলোর ফিসফিসানী হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় ... কথা বলা শেষ করলে পরে দেখে ওর পিছনে এসে দাড়িয়েছে তিন এলোকেশী কন্যা ... হৃদয় আলোড়িত সুরেলা কন্ঠে একজন বলে উঠলো -- আপনিই কি সুজন সাহেব, নতুন ভাড়াটিয়া ? ... সম্মোহিত কন্ঠে "জ্বি" বলতেই ওরা নিজেদের পরিচয় দিলো ... ওরা নাকি ত্রি-রত্ন, যাদের মাঝে দুজন বাড়ীওয়ালার মেয়ে, অন্যজন পাশের বাসার বাড়ীওয়ালার মেয়ে ... একসাথেই কলেজে পড়ছে সবাই ... কিছু মানুষ থাকে যাদেরকে অল্প পরিচয়েও মানুষকে আপন করে নেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে, এদের সকলের মাঝেই যেন তা বিদ্যমান ... প্রথম দিনের পরিচয়ে মানুষ যে এত কাছে চলে আসতে সুজনের কখনো জানা ছিলো না ... এদের মাঝে রত্নাকে সবচেয়ে হাসিখুশী আর মিশুক মনে হলো তার ... তাই সে চাওয়া মাত্রই সুজন তার সেল নম্বর ওকে দিতেই রত্না দুষ্টুমি করে বলে উঠলো -- আমি কিন্তু মিসকল দিব, কল করবেন আপনি ... ঠিকাছে ? ... সুজনও দুষ্টুমি করে বলে উঠলো -- ঠিকাছে, বিলের টাকা কিন্তু আমি বাড়ীভাড়া থেকেই কেটে রাখবো ...

সেই থেকে শুরু ওদের কথা বলা, সন্ধ্যার পরে কারেন্ট চলে গেলে ছাদের কোনা একসাথে আড্ডা, অনেক রাতে মন ভাল করে দেয়ার ছলে রত্নার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা আর বিশেষ করে রত্নার ওর প্রতি আন্তরিকতা অল্প অল্প করে যেন সুজনের হৃদয় মাঝে ভাললাগার সৃষ্টি করে চলেছিল ... এর পর যখন আবিষ্কার করলো চরম মন খারাপের সময় ফোনের মাঝে সুজনের অল্প আদর যেন মুহুর্তের মধ্যে তাকে নিয়ে যায় আবীর রং এ রাঙ্গানো স্বপ্নের দেশে, তাই তো যেদিন রাতে রত্না ওকে বলেছিল -- তোমার জন্য করা এমন পাগলামী আমি আর কখনো কারো জন্য করিনি ... শোনার পর থেকেই সুজনের মাঝে তার জন্য সৃষ্টি হওয়া ভাললাগা যে ভালবাসায় পরিনত হচ্ছে তা সে খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছিল ...

সেদিন সকাল থেকেই সুজনের মন অত্যন্ত বিচলিত, আর উৎকন্ঠায় ভরে আছে ... আজ সন্ধ্যায় সে রত্নাকে তার ভাললাগার কথা জানাবে, সেই সাথে জানাবে এতদিনে তিলে তিলে যে স্বপ্ন ভরা পৃথিবী গড়ার পরিকল্পনা ওরা করেছিল, যত জলদি সম্ভব ওকে সাথে নিয়ে তার শুরু সে করতে চায় ... মাসের শেষ, হাত ফাঁকা, তবুও জীবনের প্রথম নিজের ভালবাসার কথা জানাবে, তাই অনেক শখের ঘড়িটা এক কলিগের কাছে বন্ধক রেখে অফিস থেকে ফেরার পথে ছোট্ট একটা রিং কিনে এনেছিল, তখন থেকেই সেটিকে কিভাবে রত্নার হাতে পরাবে আর কখন কারেন্ট যাবে, তা ভাবতে ভাবতেই ভুলে গিয়েছিল ওকে ফোন করে বলতে যে , সে বাসায় ফিরেছে ... এমনকি অফিস থেকে ফিরে কিছু যে খেতে হয় তাও বেমালুম ভুলে বসে আছে ... প্রতিদিনের মতো সন্ধ্যায় কারেন্ট যাওয়ার সাথে সাথে রত্নাকে ফোন না করেই কয়েকদিনের অতি পরিচিত গুটি গুটি পায়ে ছাদে উঠে এলো ছাদের ঐ নির্দিষ্ট কোনে, যেখানে ওরা কাটিয়েছে বেশ কিছু অসম্ভব সুন্দর সন্ধ্যা ... অন্ধকারের আবছা আলোয় সুজন দেখতে পায় সেখানে দাড়িয়ে আছে তারই অতি পরিচিতার নিশ্চল ছায়া ... কাছে গিয়ে মধুর স্বরে তাকে ডাকতেই যেন ভুত দেখার মত চমকে উঠলো সে ... বললো তুমি এখানে ? আজ তুমি বাসায় ফিরেছ জানাওনি তো ... সুজন তাকে কতভাবে বুঝাতে চাইলো যে , সে ওকে সারপ্রাইজ দিবে বলেই জানায়নি তবুও সে মানতে চায় না ... রাগের চরম বহিঃপ্রকাশের সাথে বলে - চলে যাও আমার সামনে থেকে, এক্ষুনি চলে যাও ... এক সেকেন্ড থাকবে না আমার সামনে , পারলে সে যেন সুজনকে ধাক্কা মেরে সিড়ি ঘরে পাঠিয়ে দেয় ... তবুও সুজন যায় না দেখে এক সময় কান্না জড়িত কন্ঠে বলে -- তুমি এক্ষুনি চলে যাও প্লিজ ...

ঠিক এমন সময়ে ছাদে প্রবেশ করে অপরিচিত এক ছায়া মুর্তি , যাকে দেখতেই পাথরের মত নিশ্চল বাকরুদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে পড়ে রত্না ... ধীরে ধীরে কাছে এসে পাশে দাড়াতেই সুজন বুঝতে পারে এটি কার ছায়ামুর্তি ... শান্ত গলায় সে বলে -- সুজন ভাইয়া তুমি একটা চান মিয়ার দোকানের সামনে যাও, আমি আসছি ... শুষ্ক কন্ঠে শোনা যায় রত্নার করুন আর্তনাদ -- তারেক ভাইয়া .... ওর ঠোটে আঙ্গুল রেখে তারেক বলে --- সসসসসস !!!!! .... কিছুক্ষন পর ... সুজনের পা তার অসাড় শরীরকে বয়ে নিয়ে যায় একমূখী রাস্তার শেষপ্রান্তে ....




No comments: