দুটি চোখের খোঁজে
০৭ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৮:৫০

সূর্য মামা জাগার আগেই এ্যালার্মের শব্দে ওঠা, জলদি জলদি শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে নাকে মুখে কিছু দিয়েই বাস স্টপে দৌড় ... ক্লাস এ্যাটেন্ড করতে হবে সময় মতো।
বাসার পাশের বাস স্টপে যেতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ মিনিট। কিন্তু অভি আরো মিনিট ১০ হেটে এর আগের স্টপ থেকে ওঠে, কারন - পিক আওয়ার হওয়ার কারনে বাসার পাশের স্টপ থেকে উঠলে অনেক সময় দাড়িয়ে যেতে হয় পুরোটা পথ আর ঐ স্টপ থেকে উঠলে সিটে বসে যাওয়া যায়, আর সিটে বসতে পারলে ভার্সিটি পর্যন্ত যাওয়ার সময়টুকুতে নোটগুলোর উপরে চোখ বুলিয়ে নেয়া সম্ভব হয় যা ক্লাসের পড়াগুলো বুঝতে বেশ সহজ হয়ে থাকে। ২৯ নং বাসে অভি সবসময় তৃতীয় সারির জানালার পাশের সিটে বসে পড়ে, মাঝে মাঝে চোখ চলে যায় জানালার বাইরে আবার চোখ ফিরিয়ে আনে ক্লাসের নোটগুলোর উপরে.. আশে পাশে কত শত মানুষ উঠছে নামছে সেদিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ যেন নাই তার, কখনো ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মন যেন পড়ে থাকে নোটগুলোর পাতায় ... বাস থামে ভার্সিটির সামনেই , ওটাই এ প্রান্তের শেষ স্টপ.... এর পরে ক্লাস শেষ করে লাইব্রেরীতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আবার বাসে চড়ে নোটে চোখ বুলাতে বুলাতে বাসায় এসে ডিনার করে পরের দিনের জন্য কিছু গোছগাছ করে গভীর রাতে শুতে যাওয়া। এই ছিল অভির দৈনন্দিন রুটিন এ সবের বাইরে যে অন্য কোন কিছু করার থাকতে পারে তা ও একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিল ... এমন করেই কাটছিল ওর জীবন...
এক শীতের সকালে, বাইরে বেরিয়েই দেখে বৃষ্টি হচ্ছে... সেই সাথে কনকনে ঠান্ডা বাতাস যেন জ্যাকেটের উপর দিয়েই সুচের মতো বিধছিলো গায়ে ... উপায়ন্তর না দেখে ঐদিন বাসার কাছের বাস স্টপ থেকে উঠে বসার জায়গা পেয়ে দাড়িয়েই রইলো। বাইরে বৃষ্টির শব্দ কেমন এক অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল সেদিন নাকি অন্য কোনোদিন বৃষ্টিকে ও এমনভাবে দেখেনি - কে জানে, এমন সময় কি মনে করে বাসের ভিতরের মানুষগুলোর মাঝে চোখ বুলাতে গিয়েই হঠাৎ দেখলো এক জোড়া অসম্ভব সুন্দর চোখ ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ... মানুষের চোখ এত মায়াময় আর গভীর হতে পারে ওর কখনো জানা ছিলো না ... কিছুটা লজ্জায়, আড়ষ্টতায় ও বার বার সেই দুটি চোখ থেকে নিজের চোখকে সরিয়ে নিলেও কোন এক দুর্নিবার আকর্ষনে বার বার তা আবার ফিরে যাচ্ছিলো ঐ দিকেই ... ক্লাস শেষে, লাইব্রেরী ওয়ার্ক শেষ করে বাসে চড়তেই আজকে ওর চোখ দুটো বই এর পাতায় না থেকে কেন জানি বারবার চারিপাশে সেই অসম্ভব দুটি চোখকে খুজে ফিরছিলো ... কিন্তু নাহ ! সেদিন আর ঐ চোখ দুটোকে খুজে পাওয়া গেল না ....
এর পর কয়েকটা দিন কেটে গিয়েছে, প্রতিদিনের মতো দুরের স্টপ থেকে বাসে উঠে নিজের চোখের সামনে নোট খুলে রাখলেও অভির চোখ দুটো মাঝে মাঝে এদিক সেদিক খুজে ফেরে সেই দুটি চোখকে ... কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে না পেয়ে ও একরকম ধরেই নিয়েছিল যে আর কখনো পাবে না সেই অসম্ভব সুন্দর চোখের দেখা ...
কয়েকদিন পরে টার্মের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে, তাই আজকাল প্রচন্ড পড়ার চাপ... অভি আগের চেয়ে অনেক বেশী পড়ছে এসময়ে, তাই প্রাই রাতে ঘুমের কমতি হয়ে যাচ্ছে ... এমনই একদিন সময়মত ঘুম ভাঙ্গলেও আলসেমীর কারনে একটু লেট হওয়াতে বাসার কাছের স্টপ থেকে বাসে উঠে যথারীতি সীট না পেয়ে দাড়িয়ে যাচ্ছিলো ... চোখের সামনে নোট না থাকলেও মাথায় তার পড়ার বিষয়গুলোই ঘুর-পাক খাচ্ছিল ... এমনই সময় হঠাৎ পাশে দাড়ানো এক জোড়া চোখ তার চিন্তার গতিকে মুহুর্তে এলোমেলো করে দিলো ... আরে ! এ তো সেই দুটো চোখ , হৃদয়ের সব অনুভুতি গুলো যেন এক মূহুর্তে মিষ্টি আবেশে দোলা দিয়ে গেল ... এক অনাবিল সুখানুভুতিতে ছেয়ে গেল আত্মার প্রতিটি অংশ ... মুখের কথা হারিয়ে শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো ওই চোখের দিকে ... এর পরে নির্দিষ্ট স্টপে সে নেমে গেলে বাকি পথটা ঐ ভালোলাগাকে সাথে নিয়েই চললো, আর ভাবতে লাগলো কেন এমন হচ্ছে তার সাথে ? ... সে রাতেই অভির ঘুমে সিধ কেটে হানা দিলো সেই দুটি চোখ...... অপূর্ব এক ভাললাগা ছড়িয়ে তিড়িং বিড়িং করে দুষ্টুমি ভরা চোখদুটি নেচে বেড়ালো ওর চারিদিকে ঘাস ফড়িং এর মতো ... এর পর থেকে ঐ মায়াবী চোখ দেখার অদম্য নেশায় আচ্ছন্ন অভি প্রতিদিন বাসার পাশের স্টপ থেকে বাসে উঠতে শুরু করলো আর ঐ অপূর্ব চোখে চোখ রেখে অন্যরকম সুখের আচ্ছন্নে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে লাগলো ....
এর পরে এলো পরীক্ষা, অভির আম্মু বললেন - পরীক্ষার দিন গুলোতে ওকে ইউনিতে ড্রপ করে এরপরে তিনি কাজে যাবেন ...... এতে অভি একদিকে যেমন খুশী হয়েছিল যে, পরীক্ষার সময় আর বাসে কষ্ট করে যেতে হবে না , পড়ার ও একটু সময় পাওয়া যাবে ... কিন্তু মনটা কিছুটা মুষঢ়ে পড়েছিল ঐ চোখ দুটোকে অসম্ভব মিস করবে বলে .... কিন্তু মাত্র ২সপ্তাহের ব্যাপার চিন্তা করেই আম্মুকে ও জানিয়ে দিলো আচ্ছা, তোমার সাথেই আমি পরীক্ষার সময় যাবো ... মেধাবী স্টুডেন্ট অভি, তার অধ্যাবসায় আর কষ্টের ফল হিসেবে আশাতীত ভাল পরীক্ষা দিতে থাকলো ....
এর মাঝেই একদিন বাসে ফেরার পথে দেখা দিল সেই চোখ দুটি ... কেমন জানি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে , কিছুক্ষন পরে খেয়াল করলো অবাক চোখ দুটিতে একধরনের অভিমানের মেঘ জমতে শুরু করেছে ... আর নিজের মনের মাঝে অসম্ভব এক ভালো লাগার সূচনা হয়েছে ... এক সময় অভিমানী মেঘ বালিকা নিজে থেকেই বললো -- তুমি আর সকাল বেলা বাসে আসো না ? ... উত্তরে অভি অনেক কিছু বলতে চাইলেও কেন জানি সব কথা এমোলেমো হয়ে গেলো, গলার স্বর যেন নিজের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গিয়েছে .... শুধু বলতে পারলো -- পরীক্ষা চলছে তো, তাই .... এর পরে নিঃশব্দে চোখে চোখ রেখে কেটে গেল বাকিটা পথ ... এরপর থেকে প্রতিটি পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে অভি খুজে ফিরেছে সেই দুটি চোখ .... কিন্তু .....
অতঃপর....... দিন যায়, মাস যায়, বছর কেটে যায় কিন্তু অপেক্ষার প্রহর যেন আর কাটে না, কত শত বাসে ঘুরেছে সে, কত দিন কাজ ছাড়াই সকালের বাসে উঠেছে বাসার কাছের স্টপেজ থেকে শুধুমাত্র ভালোবাসার ঐ দু চোখের খোজে ... আর কানে বাজতে থাকে একটি অভিমানী কন্ঠস্বর -- তুমি আর সকাল বেলা বাসে আসো না ?
No comments:
Post a Comment