পটলচেরা সুনয়নার
হৃদয় চেরা ভাব
০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ২:২২

শীতের রাতে সবারই ইচ্ছে করে কম্বল মুড়ি দিয়ে একটা আরামের ঘুম দিতে, অথচ আমাকে যেতে হচ্ছে কিনা নাইট জার্নিতে , কেমন টা লাগে ... অবশ্য যাওয়ার জন্য মারুফ অনেক আগে থেকেই টানা হেচড়া করছিল ... একদিন পরে ওর বোনের বিয়ে, আমরা ক বন্ধু সবাই ওদের এত কাছের যেন আমরা এক বাড়ীর ছেলে, কিন্তু আজকের দিনটা পর্যন্ত পরীক্ষা থাকায় আর যাবনা ঠিক করেছিলাম, মারুফ কে তো শত রকমের ঝাড়ি পট্টি দিয়ে শান্ত করে ছিলাম কিন্তু মুন্নি আপু কে কিছুই জানাইনি ... খবর পেলাম ওদিকে মুন্নি আপু ওদের বাড়ীতে সবাইকে পৌছুতে দেখে হৈ হুল্লোড় আর আড্ডা দিয়ে বেশ আনন্দে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে ... একদিন বাদে যে এই মেয়েটার বিয়ে তা কেউ বলবে না এমনটাই মজা করছে নাকি ... মনে মনে বলছিলাম, বেঁচে গেলাম এইবারের মত, ওর বৌ ভাতেই না হয় যাওয়া যাবে । কিন্তু সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে পরীক্ষা শেষ করে বাসায় এসে ফ্রেস হতে যাব এসময় আম্মু বললো -- অন্তু মুন্নি ফোন করে তোমাকে খুজছিল, আর বলেছে বাসায় আসার পরপরই যেন তুমি ওকে কলব্যাক করো ... কি মনে করে সাথে সাথে কল দিলাম আর এর পরে শুরু হলো হবু বৌ এর ইমোশন্যাল ব্ল্যাকমেইল ... সংক্ষেপে বলতে গেলে তিনি এক কথায় বলে দিলেন আমার সব কটা ভাই বোন এসেছে এখানে বিয়েতে একটা ছাড়া, ওকে এতদিন কিছু বলিনি কারন ওর পরীক্ষা ছিল আজকে যখন তার পরীক্ষা শেষ সে নিজে বলুক তাকে কি আমি নিজে ঢাকায় গিয়ে নিয়ে আসবো নাকি সে নিজেই আজকে রাতের বাসে করে এখানে পৌছাবে, সে যদি না আসে তবে একট আফসোস নিয়ে আমি বিয়েতে বসবো আর সে আফসোস জীবনে কখনো মুছবে না ... বুঝতে পারলাম এবার আর রক্ষে নাই যেতেই হবে নাইলে মুন্নিপু মন খারাপ করবে তো করবেই যারাটা জীবন আমাকে ঝাড়ি আর বকা আর খোচানীর উপর রাখবে ... সুতরাং সুবোধ বালকের মত ফ্রেস হয়ে খেয়ে দেয়ে, কটা কাপড় নিয়ে সন্ধ্যাবেলা রওনা দিলাম কল্যানপুর বাসস্ট্যান্ডে ...
কনকনে শীতের রাত, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে বাস কাউন্টারের সামনে নেমে দুটো লম্বা টানে বুক ভরা ধোয়ায় শরীরটা গরম করে ভিতরে ঢুকেই দেখি ওয়েটিংরুম ভর্তি মানুষ। মনে মনে বলি ঈদের তো এখনো ১০ - ১২ দিন বাকী আছে এখনও এত ভীড় ক্যান , আজিব ব্যাপার ... কাউন্টারে বসা পরিচিত মামু ... গিয়া কইলাম জিয়া ভাই খবর কি ,টিকেট দেন তো দুইটা একখান যাওয়ার একখান আসার এখন যামু আর ঈদের আগে ফিরমু ... জিয়া ভাই আমার দিকে খানিক্ষন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়া কইলো -- অন্তু ভাই সামনে ঈদ এই সময়ের টিকিট সবাই আধা / একমাস আগে কাইট্যা রাখসে আর আপনি কন এখন যাইবেন আর টিকেট লাগবে ? ফিরতির টিকিট দিবার পারুম একটার যায়গায় দশটা কিন্তু এখনের টিকিট দেয়া ঝামেলা হয়া যাবে অন্তু ভাই আমারে দুইটা দিন আগে ফুন দিলেই তো আপনার লাইগ্যা রাইখা দিতাম ... আমি কইলাম -- আমার আগে প্ল্যান আছিলো না যাওনের, ঘন্টা দুই আগে হইসে এখন যাওন লাগবো আর কোন কথা নাই ... কেমনে ব্যাবস্হা করবেন আপনি জানেন ... টিকেট না দিতে পারলে ড্রাইভার মামুর গলে গল্প করতে করতে যামুগা কইলাম এর পরে কখনো কিনুম না আপনার এই বাসের টিকেট কাইরে কিনতেও দিমু না .... জিয়া ভাই কইলো -- অন্তু ভাই কি যে বলেন, আপনে বসেন আমি দেখি কি করা যায় ...
পুরা কাউন্টার জুড়ে মানুষ গিজগিজ করছে, বসার যায়গা খুজে পাওয়াই বড় মুষ্কিল হয়ে পড়লো ওদিকে কাউন্টারের ভিতরেও বাসের অনেক মানুষ ঘুরা ফিরা করছে, তাই শেষমেষ ঘুরে ফিরে যায়গা না পেয়ে দরজার সামনের রাখা ছোট্ট বেন্চে বসলাম। ভিতরের অনেক মানুষের কারনেই বুঝি ঘরটা বেশ গরম লাগছিল এখানে বেশ শীত। কিছু একটা করা দরকার ভাবতে ভাবতে পকেট থেকে বেনসনের প্যাকেট টা বের করতেই দেখি ইয়া বড় দু ব্যাগ হাতে এক সুন্দরী এসে বলছে এই যে শুনেন একটু যায়গা দেন তো ... বেন্চের একপাশে সরে গিয়ে তাকে বসার যায়গা করে দিয়ে সিগারেটে আগুন জ্বালানোতে মনযোগ দিলাম ... বেন্চটা এত বড় যে চারজন অনায়াসে বসতে পারে তার একপাশে আমি আর আরেক পাশে সুন্দরী বসার পরে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ যেন ভুমিকম্পে আমার রীতিমত বেন্চ থেকে পড়ে যাওয়ার দশা ... ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম সুন্দরী তার একটা দশাসই ব্যাগ যা কিনা তিনজনের চেয়ে বেশী যায়গা দখল করতে পারে, আমাদের দুজনের মাঝে রেখে তার উপরে হাত দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে ... আমি বললাম -- এইটা কি হলো ?
সে বললো -- ব্যাগটা নীচে রাখলে ময়লা হবে তাই উপরে তুলে রাখলাম
আমি বললাম -- ওটা যে যায়গা নিয়েছে তাতে তো আপনি ছাড়া আর কেউ বসতে পারবে না তা বুঝতে পারছেন ?
সে বললো -- আর নীচে রাখলে যে আমার নতুন ব্যাগটা ময়লা হবে সেটা বুঝতে পারছেন না ?
এতক্ষনে খেয়াল করলাম এই কটকটির অসম্ভব সুন্দর দুটো পটল চেরা চোখ আছে যা আমার খুবই পছন্দের ... তাই আর তার সাথে গ্যান্জাম না করে উঠে দাড়ালাম, ফস করে সিগারেট টা জ্বালিয়ে এক বুক ধোয়া ছেড়ে বললাম -- ওটা না রাখলে এখানে আরো অন্তত দুজন আরামসে মানুষ বসতে পারতো ...
সে আবার বলে উঠলো -- আমার ব্যাগ আমি রেখেছি , আপনি বলার কে ? আর আপনি যেভাবে সিগারেট খাচ্ছেন ওটার গন্ধেই তো আপনার পাশেও তো কেউ দাড়াতে পারবে না , ওঠা নিভিয়ে ফেলেন ...
এইবার সুজোগ পেয়ে বলে উঠলাম -- আমার সিগারেট আমি জ্বালাইসি আপনি বলার কে ?
সে বললো -- আমাদের ক্যাম্পাসে হইলে দেখায়া দিতাম
আমি কইলাম -- ঠিকানা টা দিয়ে ঢাকায় ফিরে বইলেন কবে ঐখানে যেতে হবে , যামু নে ... তখন দেখুমনে কি করতে পারেন ...
সে কইলো -- রোকেয়া হলের সামনে যদি আপনারে পাইসি কোনো দিন, তাইলেই দেইখেন কি করি ...
আমি কইলাম -- ঐ এলাকার আশেপাশেই আমার চলাচল সবসময়, আপনি আপনাগো দারোয়ানের সাথে দাড়ায়া থাইকেন কখন আমি যাই ওখান থেকে, দেখা হবেই ..
সে বললো --- দেইখা নিমু ...
আমি কইলাম -- আইচ্ছা ...
এরপরে দুজনেই চুপচাপ , ঘড়ি দেখলাম বাস ছাড়ার সময় হয়ে গিয়েছে, এখনো জিয়া ভাই কি করলো টিকিটের দেখার জন্য ভিতরে যেতেই উনি বললো -- অন্তু ভাই একটা সিটের ব্যাবস্হা মনে হয় হইসে , একজনের ফোন আসছিলো উনি আজকে কাজের ব্যাস্ততার জন্য যেতে পারবেন না, উনাকে তিনদিন পরের একটা সিট দিয়েছি ... নিবেন নাকি ?
আমি কইলাম --- নিবো নাকি মানে ?
হে হে হে করে হেসে জিয়াভাই কইলো -- জানতাম এইটাই কইবেন, নেন কাইট্যাই রাখসিলাম আগে থেকে ...
সবাই এক এক করে বাসে উঠে গেলে পরে সবার শেষে বাস ড্রাইভার আর হেলপার মামুর লগে গল্প করতে করতে বাসে উঠলাম, সিট নম্বর দেখে খুজে খুজে নিজের সিটে বসতে যাব এমন সময় সহযাত্রীর উপরে চোখ পড়তেই আবার যেন একটা ভুমিকম্পের ঝাকুনি অনুভুত হলো ... কারন জানালার পাশের সিটটা আমার, সেটা দেখি দিব্যি সেই সুনয়না চর দখলের মত দখল করে বসে রয়েছে ... আমাকে দেখে সে বলে উঠলো -- জানালার পাশের সিট টা আমার ভাল লাগে, আপনি এই পাশে বসেন
আমি বললাম -- নিতান্ত ভদ্রতা বশত কোন রকম গোলমাল ছাড়াই নিজের পছন্দের জায়গাটা আপানর জন্য ছেড়ে দিলাম, নাইলে আপনি যে হুমকী দিয়েছেন তার পরে আপানর জন্য কোন কিছু স্যাকরিফাইস করার মন আমার নেই ...
সে বললো -- ওটা তো ঢাকায় এসেই আমি দেখে নিব আপনাকে, আপাতত বাড়ী ঈদ করতে যাচ্ছি বলে আপনার সাথে কোন গোলমাল করতে ইচ্ছে হচ্ছে না ...
আমি বললাম -- মনটা চাইতেসে ঐখানের গরুর হাটে আপনারে বিক্রি করে দিয়ে আসি , সময় থাকলে ঠিকই দিয়া আসুমনে ...
সে বললো -- হুহ !!
আমি কইলাম -- ক্র্যাপ !!
এবার আশে পাশে দুজনেই তাকিয়ে দেখলাম লোকজন হা করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে, আমরা একবার মানুষজনের দিকে তাকাই আর অগ্নিদৃষ্টিতে একজন আরেকজনকে ভষ্ম করে দিতে চেষ্টা করছি ... ভাগ্য ভাল ড্রাইভার মামুও ততক্ষনের গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গান চালিয়ে দিয়েছে, আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ভিতরের লাইট টা নিভে যেতেই শুরু হলো পটল চেরা সুনয়নার সাথে এক টক ঝাল মিষ্টিতে ভরপুর এক অন্যরকম নীশিথ বাস যাত্রা ....
No comments:
Post a Comment